ত্বকের যত্নে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট কতটা গুরুত্বপূর্ণ জানা আছে কি?
সময়ের সাথে সাথে স্কিনকেয়ার ট্রেন্ডে যুক্ত হচ্ছে নানা রকম ইফেক্টিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট, যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এটির নাম মোটামুটি সবার জানা থাকলেও বিস্তারিতভাবে বেশিরভাগই জানেন না। রোগ প্রতিরোধে তো বটেই, সেই সাথে স্কিন কেয়ার রুটিনে এটি অ্যাড করা হলে অনেকগুলো বেনিফিট একসাথে পাওয়া যায়। অ্যান্টি অক্সিডেন্ট কী এবং আমাদের ত্বকের যত্নে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট কেন এত প্রয়োজন তা নিয়েই আজকের ফিচার।
অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আসলে কী?
শুরুতেই আপনাদের অক্সিডেশন বিক্রিয়া সম্পর্কে একটু আইডিয়া দেই। অক্সিডেশন বা জারণ বিক্রিয়া এক ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া যার মাধ্যমে ফ্রি রেডিক্যাল উৎপন্ন হয়। এটি আমাদের ত্বকের কোষগুলোকে ড্যামেজ করে দেয়। জারণ বিক্রিয়ার মাধ্যমে ফ্রি রেডিক্যালের পরিমাণ বেড়ে গেলে তা আমাদের শরীরে বিভিন্ন রকমের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ১৯৫৬ সালের ফ্রি রেডিক্যাল থিওরি অফ এজিং নামক একটি রিসার্চের মতে, ফ্রি রেডিক্যাল আমাদের বডির সেলগুলোকে ধীরে ধীরে ভেঙ্গে ফেলে। এর পাশাপাশি ফ্রি রেডিক্যাল এজিং প্রসেস দ্রুত করা, বলিরেখা সৃষ্টি, ত্বকে পিগমেন্টেশন বাড়ানো ইত্যাদি স্কিন কনসার্নের জন্যেও দায়ী। অতিরিক্ত ফ্রি রেডিক্যালের ফলে ত্বকের সৌন্দর্য ও উজ্জ্বলতা হারিয়ে যেতে থাকে।
অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এমন এক ধরনের অণু, যেটি আমাদের বডি ও স্কিনকে ফ্রি রেডিক্যাল ড্যামেজ থেকে রক্ষা করে এবং ফ্রি রেডিক্যালের পরিমাণ যেন বেড়ে না যায় তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। ফ্রি রেডিক্যাল ও অ্যান্টি অক্সিডেন্টের ইমব্যালেন্সের ফলে আমাদের বডিতে যে প্রবলেমগুলো দেখা দেয় তাকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বলা হয়। এই অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে আমাদের সুরক্ষা দিতে অ্যান্টি অক্সিডেন্টের গুরত্ব অনেক। এটি বিভিন্ন ধরনের রোগ ব্যাধি যেমন ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, হৃদরোগ, পারকিনসনস ডিজিজ ,ক্যান্সার ইত্যাদি প্রতিরোধ করে।
অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আমাদের আমাদের বডিতে ন্যাচারালিই বিদ্যমান থাকে। তবে বয়স বৃদ্ধি ও পরিবেশের ফ্রি রেডিক্যাল ড্যামেজের কারণে ধীরে ধীরে এর পরিমাণ কমতে থাকে। এ কারণে বিভিন্ন স্কিন কনসার্ন থেকে বাঁচতে স্কিন কেয়ার ও খাদ্যতালিকায় এটি ইনক্লুড করা প্রয়োজন।
ত্বকের যত্নে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এর গুরুত্ব
১. অ্যান্টি অক্সিডেন্ট খুবই ভালো একটি অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি ইনগ্রেডিয়েন্ট। এটি আমাদের ত্বকের জ্বালাপোড়া বা ইনফ্ল্যামেশন ও লালচে ভাব কমায়।
২. ত্বককে উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত রাখতে এটি দারুণ কার্যকরী। এটি ত্বকের হাইপার পিগমেন্টেশন কমায় এবং ব্রাইটনেস বৃদ্ধি করে।
৩. স্কিন টোন ও স্কিন টেক্সচার ইমপ্রুভ করতে এটি খুব ভালো কাজ করে। এটি ত্বকের ফাইন লাইনস ও রিংকেল দূর করতে সাহায্য করে।
৪. এটি ত্বকের হাইড্রেশন লেভেল বজায় রাখে এবং কোলাজেন প্রোডাকশন বুস্ট আপ করে। এতে করে আগের তুলনায় ত্বকের ইলাস্টিসিটি ইমপ্রুভ হয়।
৫. অতিরিক্ত ফ্রি রেডিক্যাল ড্যামেজের ফলে ত্বকে ডার্ক স্পট, হাইপার পিগমেন্টেশন কিংবা বলিরেখার মতো সমস্যা সৃষ্টি করে৷ অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এ ধরনের সমস্যা থেকে ত্বককে রক্ষা করে এবং এজিং প্রসেস স্লো ডাউন করে।
কয়েকটি অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সম্পর্কে জানুন
চলুন এবার জেনে নেয়া যাক ত্বক পরিচর্যায় ব্যবহৃত অ্যান্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে এমন কয়েকটি ইনগ্রেডিয়েন্ট সম্পর্কে।
১. ভিটামিন সি : মোস্ট ইফেকটিভ অ্যান্টি অক্সিডেন্টের তালিকায় সর্বপ্রথমে রয়েছে ভিটামিন সি। ভিটামিন সি ত্বককে ফ্রি রেডিক্যাল ড্যামেজ থেকে সুরক্ষা প্রদান করতে এবং ত্বকের ডার্ক স্পট কমাতে দারুণ কার্যকরী। মর্নিং স্কিন কেয়ার রুটিনে ভিটামিন সি যুক্ত করলে এটি সানস্ক্রিনের কার্যকারিতা বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ। এছাড়াও কোলাজেন প্রোডাকশন বৃদ্ধি, এজিং প্রসেস স্লো ডাউন ,ত্বকের টেক্সচার ইমপ্রুভ, হাইপার পিগমেন্টেশন ও ব্রণের দাগ কমাতে ভিটামিন সি খুব ভালো কাজ করে।
২.ভিটামিন ই : ভিটামিন ই যেমন অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, তেমনি খুব ভালো একটি ইমোলিয়েন্ট বা ময়েশ্চারাইজিং এলিমেন্টও বটে। ভিটামিন ই ফ্রি রেডিক্যাল ড্যামেজ থেকে সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি ত্বককে সফট ও স্মুথ করতে সাহায্য করে।
৩. নিয়াসিনামাইড: নিয়াসিনামাইড বা ভিটামিন বি৩ অত্যন্ত কার্যকরী একটি অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এটি ত্বককে ফ্রি র্যাডিকেল ড্যামেজ থেকে সুরক্ষা প্রদান করে, ওপেন পোরস কমায়, স্কিন ইনফ্ল্যামেশন কমায়, ত্বক স্মুথ করে এবং এজিং সাইনগুলোকে দূর করে।
৪. রেটিনল( ভিটামিন-এ): ত্বকের এজিং প্রসেস স্লো ডাউন করে বয়সের ছাপ কমাতে এটি ইফেক্টিভ একটি উপাদান। এর মলিকিউলগুলো খুবই ছোট হয়ে থাকে, যার ফলে এটি খুব সহজেই ত্বকের গভীরে পেনিট্রেট করে ত্বকের কোলাজেন প্রোডাকশন বাড়িয়ে তোলে। রেটিনল ত্বক থেকে বয়সের ছাপ কমাতেও সাহায্য করে।
৫.ফেরোলিক (Ferulic) অ্যাসিড: এই অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ত্বকের ডার্ক স্পট, হাইপার পিগমেন্টেশন, ফাইন লাইনস, রিংকেল ও এজিং সাইনস কমাতে সাহায্য করে। স্কিন কেয়ার রুটিনে এই অ্যান্টি অক্সিডেন্ট অ্যাড করা হলে ভিটামিন সি ও ই এর কার্যকারিতাও বৃদ্ধি পায়।
৬. রেসভেরাট্রল (Resveratrol): রেসভেরাট্রল মূলত লাল আঙ্গুর ও বেরি জাতীয় ফলের একটি ডেরিভেটিভ। এই অ্যান্টি অক্সিডেন্টটি ত্বকের কোলাজেন বুস্ট আপ করতে সাহায্য করে এবং ত্বককে ফ্রি রেডিক্যাল ড্যামেজ থেকে সুরক্ষা দেয়।
৭. গ্রিন টি: গ্রিন টি বেশ পপুলার একটি অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এটি একটি প্ল্যান্ট বেইজড অ্যান্টি অক্সিডেন্ট যা সেনসিটিভ ও ড্যামেজড স্কিনের জন্য খুবই কার্যকরী। ত্বকের জন্য বেশ জেন্টেল এই উপাদানটি। গ্রিন টি পল্যুশন ও অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে ত্বককে সুরক্ষা প্রদান করে।
কীভাবে ব্যবহার করবেন?
অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অবশ্যই স্কিন টাইপের সাথে মানানসই এবং সঠিক কনসেনট্রেশন বুঝে ব্যবহার করতে হবে। তা না হলে ইরিটেশন, লালচে ভাব, ইচিং,ড্রাইনেস ও ফ্লেকি স্কিন ইত্যাদি সাইড ইফেক্টস দেখা দিতে পারে। সেই সাথে দিনের বেলা সানস্ক্রিন ইউজ করতে ভুলবেন না। চলুন এবার জেনে নেয়া যাক স্কিন কেয়ারে অ্যান্টি অক্সিডেন্টের সাথে কোন কোন অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট ব্যবহার করা যাবে এবং কোনগুলো যাবে না। যে উপাদানগুলো অ্যান্টি অক্সিডেন্টের সাথে ব্যবহার করা যাবে সেগুলো হলোঃ
১. ভিটামিন সি, ভিটামিন ই অথবা ফেরুলিক অ্যাসিড, এই অ্যান্টি অক্সিডেন্ট গুলোকে সকালের স্কিন কেয়ার রুটিনে ব্যবহার করা যাবে। এগুলো সানস্ক্রিনের কার্যকারিতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয় এবং সারাদিন ত্বককে ফ্রি রেডিক্যাল ড্যামেজ থেকে সুরক্ষা প্রদান করে।
২. রেটিনলের সাথে একই স্কিন কেয়ার রুটিনে নিয়াসিনামাইড ও রেসভেরাট্রল যুক্ত করলে ভিটামিন এ বা রেটিনলের কার্যকারিতা বেড়ে যায়। এছাড়াও রেসভেরাট্রল (Resveratrol) ও নিয়ানামাইড যথেষ্ট সুদিং এলিমেন্ট হওয়ায় এটি রেটিনল থেকে হওয়া ইরিটেশন থেকেও ত্বককে রক্ষা করে।
৩. আন্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে এমন ইনগ্রেডিয়েন্টের সাথে হায়ালুরোনিক অ্যাসিড খুব সহজেই মানিয়ে যায়। অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও হায়ালুরোনিক অ্যাসিডের কম্বিনেশন ত্বকের ফাইন লাইনস ও এজিং সাইনগুলোকে খুব দ্রুত কমিয়ে আনতে সাহায্য করে এবং ত্বকের উজ্জ্বলতাও বৃদ্ধি করে।
যে উপাদানগুলো অ্যান্টি অক্সিডেন্টের সাথে একই রুটিনে ব্যবহার করা যাবে না
১. ভিটামিন সি এর কার্যকারিতা বজায় রাখার জন্য স্কিনে একটি নির্দিষ্ট পি এইচ ব্যালেন্স মেনটেইন করা প্রয়োজন। কিন্তু ভিটামিন সি যদি নায়াসিনামাইড অথবা বেনজোয়েল পারঅক্সাইডের সাথে একই রুটিনে অথবা একই সময়ে ব্যবহার করা হয়, তবে এর পি এইচ লেভেল নষ্ট হয় এবং ভিটামিন সি তার কার্যকারিতা হারায়। তাই স্কিন কেয়ার রুটিনে ভিটামিন সি ও নায়াসিনামাইড অথবা বেনজোয়েল পার অক্সাইড একই সময়ে ব্যবহার করা যাবে না। বরং দিনে ভিটামিন সি ব্যবহার করলে রাতের রুটিনে বাকি উপাদানগুলো ব্যবহার করতে হবে।
২. রেটিনল কিছুটা পাওয়ারফুল অ্যাকটিভ ইনগ্রেডিয়েন্ট হওয়ায় রেটিনল ও ভিটামিন সি একই রুটিনে কম্বিনেশন করে ব্যবহার করা যাবে না। এগুলোর মধ্যে একটি ব্যবহার করলে রুটিনে অন্যটি রাখা যাবে না।
নজর দিন নিজের খাদ্যাভ্যাসে
ত্বক পরিচর্যার পাশাপাশি আমাদের খাদ্যাভাসেও পরিবর্তন আনতে হবে, এতে আমাদের শরীরে অ্যান্টি অক্সিডেন্টের পরিমাণ ন্যাচারালি বৃদ্ধি পাবে। যার ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে এবং ত্বকের তারুণ্য বজায় থাকবে। অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবারগুলো থেকে অন্তত একটি হলেও প্রতিদিনের খাদ্যাভাসে রাখা অত্যন্ত জরুরি। রেগুলার ডায়েটে এই খাবারগুলো রাখতে পারেনঃ
১. বিভিন্ন ধরনের শাক সবজি ও ফলমূল
২.ভিটামিন সি (যেমনঃ লেবু,কমলা, মাল্টা), ভিটামিন ই ও বিটাক্যারোটিন( যেমন: গাজর) সমৃদ্ধ খাবার
৩.কাঠবাদাম, আখরোট
৪.গ্রিন টি
৫.আনারস, আঙ্গুর, খেজুর
৬.ভুট্টা
৭.লাল আটা
৮.জলপাই, বাদাম তেল, উদ্ভিজ্জ তেল
৯. ক্যালসিয়াম ও আঁশ সমৃদ্ধ বিভিন্ন খাবার ইত্যাদি
এটুকুই ছিলো ত্বকের যত্নে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এর গুরুত্ব নিয়ে আজকের আলোচনা। আশা করি আপনাদের সব কনফিউশন ক্লিয়ার করতে পেরেছি। গ্লোয়িং ও নারিশড স্কিন পেতে স্কিন কেয়ার রুটিনে এটি অ্যাড করে দেখতে পারেন।
No comments